বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারে অনাগ্রহী গ্রাহক!
ঢাকা ব্যুরো: বিদ্যুতের অপচয় রোধ, চুরি ঠেকানো প্রভৃতি কারণে পুরো দেশকে প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটারের আওতায় আনার কাজ চলছে। এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসানো হয়েছে এ মিটার। কিন্তু সুফলের পরিবর্তে বাড়তি বিল, অযাচিত ফি ও ব্যবহার পদ্ধতি গ্রাহকবান্ধব না হওয়ায় গ্রাহকেরা এমন মিটার পদ্ধতিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। প্রিপেইড মিটার বন্ধে দেশজুড়ে চলছে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ।
জানা যায়, সারাদেশে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এসব মিটার স্থাপন ও পরিচালনের সার্বিক কাজগুলো করে। এগুলো হলো- ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি-ডেসকো, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি-ডিপিডিসি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড-আরইবি বা পল্লী বিদ্যুৎ, পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড-পিডিবি, পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি-ওজোপাডিকো ও নর্দার্ন ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি-নেসকো। প্রত্যেকেই স্বাধীন যার যার কাজে।
২০২৫ সালের মধ্যে গ্রামসহ দেশের সব বিদ্যুৎগ্রাহককে প্রিপেইড মিটার ব্যবস্থায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে ২০১৭ সাল থেকে দেশে শুরু হয় প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ। দেশের প্রায় সোয়া তিন কোটি বিদ্যুৎগ্রাহকের মধ্যে প্রায় ১৭ লাখের বেশি গ্রাহক এখন প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছেন। তবে প্রিপেইড মিটার সংযোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই মিটার ব্যবহারকারীর ভোগান্তি।
প্রিপেইড মিটার নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পল্লী বিদ্যুতের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ঢাকার আশপাশের ১১টি সমিতির আওতায় বেশ কয়েকটি জেলায় প্রিপেইড মিটার সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি। এছাড়াও যেসব এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের লোকজন মিটার স্থাপনে যাচ্ছেন সেখানেই ফুঁসে উঠছেন স্থানীয় জনগণ। গত এক সপ্তাহে গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ এবং পিরোজপুরে মানববন্ধন ও মহাসড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। কোথাও কোথাও পল্লী বিদ্যুতের অফিস ঘেরাও করছেন উত্তেজিত জনতা।
প্রিপেইড মিটার নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে আছে বাড়তি বিদ্যুৎ বিল আসা, অযাচিতভাবে মিটারকেন্দ্রিক বিভিন্ন ফি গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া (ডিমান্ড চার্জ, ভ্যাট ও ট্যাক্স), মিটার রিচার্জের পর্যাপ্ত জায়গা ও ব্যবস্থা না থাকা। পাশাপাশি মিটার ভাড়া হিসেবে প্রতিমাসে গ্রাহকদের গুনতে হয় আরও ৪০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা।
মিটারের মালিক না হয়েও কোনো ভবনে ভাড়াটিয়া থাকলে এই অর্থ ভবন মালিকদের বদলে দিতে হয় ভাড়াটিয়াদেরই। এছাড়াও নতুন মিটারের দাম গোপন রাখা হচ্ছে গ্রাহকদের কাছ থেকে। ফলে প্রতিমাসের এই ভাড়া ও ডিমান্ড চার্জের বোঝা কবে নাগাদ শেষ হবে তাও জানেন না গ্রাহকেরা।
রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে প্রায় সব জায়গা থেকেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে গ্রাহকদের।
গাজীপুরের বাসিন্দা নাহিদুল ইসলাম বলেন, গত মে মাসেও আগের সাধারণ মিটারে পুরো মাসে বিল এসেছিল ৮শ টাকার মতো। সেখানেই ২১ জুন পর্যন্ত প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করতে হলো ৭শ টাকা। এমন কেন হবে? এমন হলে তো এই প্রিপেইড মিটার দরকার নেই।
অন্যদিকে প্রতিবার বিল রিচার্জের সঙ্গে মিটার ভাড়া ৪০ টাকা ও ডিমান্ড চার্জ ৫০ টাকাসহ মোট ৯০ টাকা দিতে হয় বলে অভিযোগ করেন রাজধানীর মিরপুর ৬০ ফিট এলাকার এক গৃহিণী নাইমা আক্তার। তিনি বলেন, আগে বিল আসতো ১২শ থেকে ১৫শ টাকা; খুব বেশি হলে দুই হাজার। সেখানেই এই মাসে এখন পর্যন্ত ২৩ জুন মিটারে রিচার্জ করতে হয়েছে তিন হাজার টাকার বেশি।
একইসঙ্গে প্রতিবার যাই রিচার্জ করি না কেন ৯০ টাকা আগেই কেটে নেয়। অথচ মিটার স্থাপনের আগেই আমরা মিটার ভাড়া দিয়েছিলাম। আর আগারগাঁওয়ের বিদ্যুৎ অফিস থেকে জানানো হয়েছিল যে, ডিমান্ড চার্জ ও মিটার ভাড়া মাসে একবার কাটবে। এই মাসে চারবার রিচার্জ করেছি আমি। চারবই ৯০ টাকা করে দিতে হয়েছে আমাকে। ডিজিটালের নামে এমন ভোগান্তি আমরা চাই না।
গ্রাহকদের এতোসব অভিযোগ থাকলেও প্রিপেইড মিটারের পক্ষেই অবস্থান সরকারি দপ্তরগুলোর। মিটার নিয়ে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা যেমনই হোক প্রিপেইড মিটার ব্যবস্থাকে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহকদের উভয়ের জন্যই ভালো বলে দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের।
প্রিপেইড মিটারকে উভয়পক্ষের জন্য ‘উইন-উইন’ উল্লেখ করে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান এভরিনিউজকে বলেন, বিতরণকারী সংস্থা হিসেবে আমি আগেই আমার টাকা পেয়ে যাচ্ছি আর গ্রাহকও জানতে পারছেন যে তারা কত টাকার বিদ্যুৎ গ্রহণ করেছেন এবং আরও সামনে কত লাগবে।
মিটারের ফি নিয়ে ভাড়াটিয়া ও ভবন মালিকদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিপিডিসির এমডি বলেন, আমাদের জন্য তো আসলে ভাড়াটিয়া বলে কিছু নেই। আমরা মিটারগুলো মালিকদের (ভবন বা ফ্ল্যাট) দিয়েছি। এগুলোর দাম নিয়েও কোনো লুকোচুরি নেই। সরকার নির্ধারিত দাম ও ফি নেওয়া হচ্ছে। যিনি জানতে চান তারা আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেই তো আমরা বলে দেই। পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে একজন মালিকের একটি মিটারের মূল্য পরিশোধ হয়ে যাবে।
প্রায় একই রকম বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন।
তিনি বলেন, প্রিপেইড মিটার একটি ‘ঝামেলামুক্ত’ ব্যবস্থা। ব্যবস্থাটি ভালো না হলে তো সেগুলোকে স্থাপন করার পরিকল্পনা নেওয়া হতো না। প্রিপেইড মিটারে বিল বেশি আসার অভিযোগটি সঠিক নয়। যারা অভিযোগ করছেন তারা হয়তো মিটারটিকে সেভাবে বুঝতে পারেননি। এছাড়াও এটি একটি স্মার্ট সিস্টেম। স্মার্ট মিটারের পাশাপাশি স্মার্ট গ্রিড ও বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যেকারণে আগের মিটারের মাসিক ভাড়া ১০ টাকা থেকে এই মিটারে ৪০ টাকা করা হয়েছে।
এরজন্য আমরা গ্রাহকদের সচেতন করতে ও এই মিটার সম্পর্কে তাদের জানাতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন ধরনের প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছি। তারা বুঝে গেলে তাদের আর এটি নিয়ে কোনো সমস্যা মনে হবে না। মূলত আগের মিটারে অনেক গ্রাহক দেখা যেতো মাসের পর মাস বিল বকেয়া রাখতেন। এই মিটারে সেটি সম্ভব না হওয়াতেই এর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন অনেকে।
প্রিপেইড মিটার নিয়ে কিছু অভিযোগ থাকার কথা অবশ্য স্বীকার করেছেন ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল) এ কে এম মহিউদ্দীন। তিনি এভরিনিউজকে বলেন, কিছু অভিযোগ আছে তবে সেগুলো সাধারণ নন-স্মার্ট প্রিপেইড মিটার নিয়ে, স্মার্ট প্রিপেইড মিটার নিয়ে নয়। আমাদের প্রায় নয় লাখ ৬০ হাজার গ্রাহক। যাদের মধ্যে প্রায় তিন লাখ গ্রাহককে আমরা প্রিপেইড মিটারের আওতায় এনেছি। এদের মধ্যে প্রায় দুই লাখ গ্রাহকের মিটার স্মার্ট প্রিপেইড মিটার; বাকিদের সাধারণ প্রিপেইড মিটার। সমস্যা বা অভিযোগ যেটি পাচ্ছি সেটা হচ্ছে, সাধারণ প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীদের ভেন্ডিং স্টেশনগুলোতে গিয়ে মিটার রিচার্জ করাতে হয়। তবে যাদের স্মার্ট প্রিপেইড মিটার তাদের এমনটা করতে হয় না। তারা ভেন্ডিং স্টেশনে বা ব্যাংকে না গিয়েও মোবাইল ব্যাংকিং এবং ব্যাংকের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দিয়েও যেকোনো দিন ও সময়ে মিটার রিচার্জ করতে পারেন। ননস্মার্টদের আমরা স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের আওতায় নিয়ে আসছি।
অন্যদিকে মিটারের ভাড়া থেকে গ্রাহকদের মুক্তি দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন অবস্থায় আছে বলে জানান ডেসকোরর এই কর্মকর্তা।